বর্তমান যুগে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করেছে। ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মানুষ নিজের কথা, চিন্তা, এবং সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মগুলির এক বিশেষ দিক রয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তা হলো, অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ভিডিও তৈরি এবং শেয়ার করা। সেগুলি তরুণ সমাজের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে পড়ছে এবং তাদের মানসিকতা, সম্পর্ক এবং নৈতিকতায় গভীর প্রভাব ফেলছে। একদিকে যেমন এসব ভিডিও সমাজে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে তরুণরা এসব ভিডিও দেখে ভুল ধারণা তৈরি করছে এবং সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপদে পড়ছে। এ ধরনের ভিডিওতে একটি নতুন ‘ট্রেন্ড’ তৈরি হয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, চীন এবং রাশিয়া এসব দেশগুলোতে অশ্লীল ভিডিও তৈরি ও শেয়ার করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ এবং ভারত এ ধরনের ভিডিও তৈরির জন্য শীর্ষে রয়েছে। এসব ভিডিও সাধারণত কৌতুক, মজা এবং আকর্ষণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়, যাতে বেশি বেশি ভিউ আসে এবং তাদের ভিডিওগুলো জনপ্রিয় হয়। তবে এতে খুব দ্রুত অশ্লীলতা ও কুরুচিপূর্ণ উপাদান যোগ করা হয়, যা যুব সমাজের মানসিকতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এসব অশ্লীল ভিডিও যুব সমাজের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটাতে সাহায্য করছে। অনেক তরুণ-তরুণী যে ভিডিওগুলো দেখে, তার মধ্যে তাদের ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্কের ধরন এবং জীবনযাত্রার অনেক কিছু গঠিত হয়। যখন তারা এসব ভিডিও দেখে, তখন তাদের মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয় এবং তারা সামাজিক সম্পর্কের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করে। বিশেষভাবে, যারা এগুলোর প্রতি আগ্রহী, তাদের মনে স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রতি অস্বাস্থ্যকর ধারণা তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে জীবনে বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়াও, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিও দেখার কারণে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনে স্ক্রীন দেখতে দেখে চোখে সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা, এবং ঘুমের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্ক্রীনের নীল আলো মানুষের ঘুমের চক্রে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, ফলে মানসিক ক্লান্তি এবং অবসাদ বাড়ছে। এছাড়া, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে মনোযোগের অভাব দেখা দিচ্ছে, যা পড়াশোনা এবং অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের জন্য ক্ষতিকর।
পরিবার এবং শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের মোবাইল ব্যবহারের বিষয়ে নজর রাখেন না, যার ফলে শিশুরা অনলাইনে অশ্লীল ভিডিও দেখতে থাকে। তবে, এটি শুধুমাত্র বাবা-মায়েরই দায়িত্ব নয়, শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া উচিত। এছাড়া, পরিবারে শিশুদের এবং তরুণদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে তারা মোবাইল ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়াতে অতিরিক্ত সময় না কাটায়। মা-বাবাদের উচিত সন্তানদের জানানো যে, সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু কনটেন্ট তাদের জন্য নিরাপদ নয় এবং তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই ধরনের কনটেন্ট একেবারে রোধ করা সম্ভব নয়, তবে সতর্কতা, সচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে সমাজকে একটি স্বাস্থ্যকর ডিজিটাল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। সরকার, সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং পরিবারগুলোর যৌথ উদ্যোগে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও কঠোর নীতিমালা তৈরি করতে হবে এবং অশ্লীল কনটেন্টের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তবে, এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে বড় ভূমিকা পালন করে, কিন্তু তাদের সঠিক ব্যবহার ও নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, ইন্টারনেট ব্যবহারের উপযুক্ত নিয়ম ও সীমা তৈরি করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্মকে এই ধরনের নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করা যায়।
ইসলামে অশ্লীলতা ও পর্ণগ্রাফির ব্যাপারে নির্দেশনা এবং শাস্তি:
ইসলাম পর্ণগ্রাফি ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকার জন্য অত্যন্ত কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে এবং মুসলিমদেরকে এসব থেকে বাঁচতে উৎসাহিত করেছে। ইসলামে পর্ণগ্রাফি, অশ্লীল ভিডিও বা কোনো ধরনের যৌন আপত্তিজনক বিষয়কে হালাল বা গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা হয়নি। এটি মুসলিমদের নৈতিকতা, পরিবারিক সম্পর্ক এবং সমাজের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। ইসলাম ধর্মে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
চোখের দিকে তাকানো: ইসলাম নারীদের বা পুরুষদের একে অপরের দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকানোর ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আল্লাহ বলেন,
“মুমিন পুরুষদেরকে বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গকে নিরাপদ রাখে। এটা তাদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র।” (সূরা নূর ২৪:৩০)
শরীরের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা: ইসলামে পুরুষ ও নারী উভয়কে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লজ্জাস্থান ছাড়া প্রকাশ না করার ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পুরুষ ও নারী, উভয়কে একে অপরের প্রতি যৌন আকর্ষণ কমাতে বলা হয়েছে।
যৌন সম্পর্কের জন্য বৈধতার প্রয়োজন: ইসলামে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ককে বৈধ এবং অনুমোদিত হিসেবে দেখা হয়েছে। পর্ণগ্রাফি বা অশ্লীল ভিডিও দেখে মানুষ যৌন ইচ্ছা পূর্ণ করার মাধ্যমে ভুল পথে যেতে পারে, যা ইসলামের আদর্শের বিপরীত।
জীবনে শালীনতা: ইসলাম শালীনতার গুরুত্ব প্রদান করে এবং কোনোভাবেই মানুষের যৌন ইচ্ছা ও অনুভূতির প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ না দিতে উৎসাহিত করে। এমন কোনো কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে যা মানুষের মনের মধ্যে অশ্লীলতা এবং ভুল চিন্তা সৃষ্টি করে।
পর্ণগ্রাফি বা অশ্লীলতা দেখার শাস্তি:
ইসলামে এমন কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন ধরনের শাস্তির নির্দেশনা রয়েছে, যদিও শাস্তির বিষয়টি ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় বিচারকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। ইসলামিক শাস্তি বিশেষত কোনো শাস্তির ব্যবস্থা (যেমন শারীরিক দণ্ড) খোদ বিচার ব্যবস্থায় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে, মুসলিমদের জন্য পর্ণগ্রাফি বা অশ্লীল ভিডিও দেখার বিষয়টি খুব গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, এবং এর ফলস্বরূপ নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতা ও ব্যক্তিগত বিপর্যয় হতে পারে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ শাস্তি:
-
বৈধ সম্পর্কের বাইরে যৌনতা (জিনা বা ব্যভিচার): ইসলামে কেউ যদি অবৈধ যৌন সম্পর্ক (যেমন জিনা বা ব্যভিচার) তৈরি করে, তাহলে তা খুবই গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং এই অপরাধের জন্য শাস্তি হতে পারে।
-
অশ্লীল ভিডিও তৈরি বা শেয়ার করলে শাস্তি: কেউ যদি অশ্লীল ভিডিও তৈরি বা শেয়ার করে, তা ইসলামে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, এবং এতে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
ইসলামে পর্ণগ্রাফি ও অশ্লীলতা একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, কারণ এটি মানুষের চরিত্র, নৈতিকতা, সম্পর্ক এবং সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মুসলিমদেরকে এ ধরনের ভিডিও বা কনটেন্ট থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম শরীর ও মনকে পবিত্র রাখতে চায় এবং এটিই একজন মুসলিমের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই, মুসলিমদের উচিত এসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা এবং আল্লাহর কাছে তওবা করা, যাতে তারা তাঁর দয়া ও ক্ষমা লাভ করতে পারে।