আপডেট সময়
০৩:২৭:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪
27
খাসিয়া পুঞ্জিতে পান সংগ্রহের পর নারীরা কান্তা তৈরিতে ব্যস্ত, যা পান বিক্রির প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময়ী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল নানা কারণে বেশ পরিচিত। চা পাতা, লেবু, আনারস বাগান আর পাহাড় পরিবেষ্টিত এ উপজেলাকে চায়ের রাজধানী বলা হয়। এছাড়া এখানকার খাসিয়া পানের বেশ কদর রয়েছে দেশ-বিদেশে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার খাসিয়া পান পুঞ্জি থেকে শহরের আড়ৎগুলোতে নিয়ে আসেন দাদন কারবারিরা। আড়ৎ থেকে পাইকাররা সেগুলো ক্রয় করে পাঠিয়ে থাকেন সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায়। সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আবার কিনে নেন খুচরা বিক্রেতারা। এভাবেই কয়েক হাত বদলে খাসিয়া পান খিলি হয়ে মুখে যায় পানখোরদের। কিন্তু এসব হাত বদলের আগে পানকে সংগ্রহ করতে হয় বাঁশের লম্বা মইয়ের মাধ্যমে উঁচু গাছ থেকে। আর এসব কাজ করেন খাসিয়া পুরুষরা। সেগুলোকে বিক্রি উপযোগী করতে বিরামহীনভাবে ঘরে ঘরে কাজ করেন খাসিয়া নারীরা। মূলত তাদের কোমল হাতের ছোঁয়ায়ই খাসিয়া পান রূপ নেয় বিক্রির সাজে।
সম্প্রতি উপজেলার ৬নং হোসেনাবাদ খাসিয়া পুঞ্জিতে সরেজমিনে নারী-পুরুষদের কর্মব্যস্ততা দেখে এবং তাদের সাথে কথা বলে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, কাক ডাকা ভোর থেকে খাসিয়া পুরুষরা পান তোলার বেতের ঝুড়ি, বাঁশের মই এবং ছোট দা নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন পান সংগ্রহে। এক গাছ থেকে অন্য গাছে মইয়ের মাধ্যমে তারা সংগ্রহকৃত পান নিয়ে আসেন বসতঘরে। এরপর শুরু হয় নারীদের কর্মযজ্ঞ। তারা পানকে বাছাই করে ‘কান্তা’ করে বেঁধে রাখেন।
কার্ণি সুরং নামের খাসিয়া নারী জানান, প্রতি ১৪৪ পান পাতাকে একত্র করে ‘কান্তা’ করা হয়। আবার ২০ কান্তাকে পানের ‘কুড়ি’ বলা হয়। এভাবে প্রতি ‘কুড়ি’ পান বর্তমান বাজারে ৮৫০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে কিছু দিন আগে সেই দাম তারা পাননি। তখন প্রতি ‘কুড়ি’ পান বিক্রি করতে হয়েছে আড়াই/তিন’শ টাকায়। এখন শুকনো মৌসুম থাকায় পুঞ্জিতে পান কমেছে, তাই দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে। তবে এসব পান ‘কান্তা’ ‘কান্তা’ করে ‘কুড়ি’ করতে একার পক্ষে সম্ভব হয় না। এসব কাজের জন্য লোক রাখতে হয়। তাদেরকে প্রতি কুড়ি পানে ৬০ টাকা দেওয়া হয় মজুরি। প্রতিদিন আড়াই/তিন কুড়ি পান বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতে পারেন তারা। দাদন কারবারিরা পুঞ্জি থেকেই পান সংগ্রহ করেন, তাই তাদের আর কোনো খরচ হয় না।
খাসিয়া যুবক বিল ক্লিনটন সুরং ও বয় সুরং বলেন, “আমরা পুরুষরা সারা দিন গাছ থেকে পান সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসি। আর মহিলারা সেগুলোকে বিক্রির উপযোগী করে ‘কান্তা’ করতে সারা দিন ঘরে বসে কাজ করেন।” কান্তা করার কাজ মূলত ঘরের নারীরাই করে থাকেন। পুঞ্জিতে চুরি-ডাকাতির উপদ্রব না থাকলেও বর্ডারঘেঁষা থাকায় সারাক্ষণ সচেতন থাকতে হয়। আমরা তো পরিবেশের কোনো ক্ষতি করি না। বরং গাছই হচ্ছে আমাদের প্রাণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পুঞ্জির বড় বড় গাছ চা বাগান কর্তৃপক্ষ কেটে নিয়ে যায়। না দিতে চাইলে চা বাগান কর্তৃপক্ষ আমাদের যাতায়াতের সড়ক বন্ধ করে দেয়, বলছিলেন তারা।
পুঞ্জির বাসিন্দা কেসেন টাম ও তার স্ত্রী ববি সুরংয়ের সাথে কথা হয়। তারা জানান, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ৫ সদস্যের পরিবার ছিল তাদের। এখন আরো দুই জন পরিবারে যুক্ত হয়েছেন। বছর দেড়েক আগে বড় মেয়ে বিয়ে করে জামাই নিয়ে এসেছে বাড়িতে। মেয়ের ঘরে একটি নাতনি হয়েছে ৫/৬ মাস আগে। এখন পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতজন। কেসেন টাম কিছু দিন আগে স্ট্রোক করেছেন। এরপর থেকে প্যারালাইজড হয়ে বাসায় বিশ্রামে রয়েছেন। এখন তিনি কাজ করতে পারেন না। ঘরের নতুন অতিথি নাতনিকে নিয়েই সময় কাটান। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে থাকায় শহরে এসে থেরাপি নিতে পারেন না। বাসায় বনাজী চিকিৎসা নিচ্ছেন নিয়মিত। নিজের চাষ করা বাগান থেকে মেয়ের জামাই পান সংগ্রহ করেন। সংগ্রহকৃত পানগুলোকে ববি বিক্রির জন্য পান কান্তা কান্তা করেন দুই মেয়েকে নিয়ে।
তারা আরো জানান, “রীতিনুযায়ী খাসিয়া মেয়েরা পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে বাবার বাড়িতে নিয়ে আসে। তাদের মেয়েও তাই করেছে। তবে মাঝে মাঝে মেয়ে তার শশুরবাড়ি বেড়াতে যায় জামাইকে নিয়ে। এভাবে প্রাইমারিতে পড়–য়া তাদের একমাত্র ছেলেও একদিন চলে যাবে তার শশুরবাড়িতে। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়–য়া ছোট মেয়ে এখনো বিয়ে করেনি। সে মা-বোনের সাথে পানের কান্তা তৈরীতে সাহায্য করে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের এখন আর পান চাষে পোষায় না বলে জানান কেসেন টাম-ববি দম্পতি।
৬নং হোসেনাবাদ খাসিয়া পুঞ্জির মান্ত্রী (খাসি নেতা) ওয়েল সুরং নয়া দিগন্তকে জানান, প্রায় ৪৫ বছর আগে হোসেনাবাদ চা বাগানের তৎকালীন মালিকের কাছ থেকে পাহাড়ের অনাবাদি জমি লিজ নিয়ে তারা পান চাষ শুরু করেন। সেই পান চাষের জন্য কয়েকটি পরিবার বসতি শুরু করেন জনবিহীন জঙ্গলে। শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে ভারতের সীমানা ঘেঁষা ছোট্ট এই পুঞ্জিতে তাদের দখলে রয়েছে প্রায় ১০০ একর জমি। যদিও বিগত ২০ বছর ধরে তাদের লিজের কোনো কাগজ নবায়ন করে দেয়নি চা বাগান কর্তৃপক্ষ। তবে মৌখিকভাবে বছরে দেড়/দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেন তিনি বাগান কর্তৃপক্ষকে। সেই টাকা দিতে দেরি হলে চা বাগান কর্তৃপক্ষের দ্বারা নানা ভাবে হয়রানির কথাও জানান নয়া দিগন্তকে। বর্তমানে পুঞ্জিতে ২২/২৩টি পরিবার রয়েছে। জনসংখ্যায় দু’শর কাছাকাছি হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবু তালেব বলেন, “শ্রীমঙ্গলে যতগুলো খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে এর মধ্যে হোসেনাবাদ পুঞ্জিটি তুলনামূলক দুর্বল এবং দুর্গত। তবে পরিবেশের সাথে ভারসাম্য রেখে তাদের গোছানো ও পরিপাটি জীবন ব্যবস্থা যেকোনো গ্রামের চেয়ে সুন্দর। তারা বিভিন্ন বনজ গাছের পাশাপাশি সুপারি গাছে খাসিয়া পান চাষ করেন। পানের দাম কমে গেলে কিছুটা বিপাকে পড়েন তারা। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। তারা অনেক পরিশ্রমী এবং অতিথিপরায়ণ।”
তিনি আরো বলেন, “প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনাময়ী ও সমৃদ্ধশালী একটি এলাকা। এখানে অনেক ধর্ম, বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠির কৃষ্টি-কালচার রয়েছে। সেসব বিষয় বিবেচনায় এনে প্রথমবারের মতো আমরা ‘খাসি কমিউনিটি ট্যুরিজম’ এর উদ্যোগ নিয়েছি। এটি যেমন পর্যটন শিল্পের জন্য নতুন সংযোজন, তেমনি তাদের বিকল্প আয়ের একটি ব্যবস্থা।”