জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১। দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটি প্রথম রায়।
রায় ঘোষণার সময়, গঠন ও সারসংক্ষেপ
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১ এর এজলাসে এই মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এই ট্রাইব্যুনালে আরও ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
মোট ৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায় ছয়টি অংশে বিভাজিত করে পর্যায়ক্রমে আদালতে পড়ে শোনানো হয়। শুরুতে ট্রাইব্যুনাল আদালতের এখতিয়ার, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক আইন ও রোম স্ট্যাটিউট অনুযায়ী সুপিরিয়র বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আইনি কাঠামো তুলে ধরে।
কোন কোন অভিযোগে কী রায়
এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের নির্দেশ প্রদান এবং সুনির্দিষ্ট কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রাখার অভিযোগ।
রায়ের মধ্যে উল্লেখ করা হয়, মামলার দ্বিতীয় নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং প্রথম নম্বর অভিযোগে তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকেও এক অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের স্বার্থে দোষ স্বীকার করে সাক্ষ্য দেওয়ায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি নিয়ে আদালতের মত
রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করে, গণ–অভ্যুত্থানকালে আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং বিভিন্ন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি (উর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায়) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন মাঠপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে এই নির্দেশ বাস্তবায়নে সহায়তা ও সমন্বয় করেন। আদালত মত দেয়, নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারীরা সবাই মিলে একই অপরাধের শৃঙ্খলে যুক্ত এবং তাদের দায় যৌথভাবে বিবেচ্য।
সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ
ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত অভিযোগপত্রে বলা হয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা—এগুলোসহ বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে এই মামলার আসামিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
আদালত সাক্ষ্য–প্রমাণ ও উপস্থাপিত অডিও–ভিডিও বিশ্লেষণ করে মত দেয়, এসব ঘটনা ছিল পরিকল্পিত, সমন্বিত এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে পরিচালিত হামলার অংশ, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
অডিও–ভিডিও প্রমাণ ও সাক্ষ্য
রায় ঘোষণার আগে ও চলমান প্রক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন অডিও, ভিডিওসহ নানা ধরনের তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ছিল গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন জনের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোনে কথোপকথনের অডিও ক্লিপ, যেখানে আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ, হেলিকপ্টার থেকে গুলি এবং বিশেষ বাহিনী মোতায়েনের মতো বিষয় উঠে আসে বলে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ও হামলার দৃশ্য ধারণ করা অসংখ্য ভিডিওচিত্র, সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী সাক্ষীদের জবানবন্দি আদালতে উপস্থাপিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টের নির্বাচিত অংশও আদালতে পড়ে শোনানো হয়।
তিন আসামির বর্তমান অবস্থান
মামলার নথি অনুযায়ী, এই মামলার তিন আসামির মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বর্তমানে পলাতক এবং দুজনই ভারতে অবস্থান করছেন। অপরদিকে, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন দেশে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকাকালীন সময়ে দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বলে রায়ে উল্লেখ আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছে, গণ–অভ্যুত্থান সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় এই প্রথম রায় ঘোষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে এ ধরনের অন্য মামলাগুলোর বিচারে এটি একটি রেফারেন্স হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রেক্ষাপট: কোটা আন্দোলন থেকে গণ–অভ্যুত্থান
রায়ের বিশদ অংশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো এবং পরবর্তীতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া গণ–অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি সহনশীলতা না দেখিয়ে শক্ত প্রয়োগের নীতিই পরবর্তীতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে।
যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত–আহত ব্যক্তিদের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয়দের বক্তব্য সংকলন করে মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বলেছে, মাঠপর্যায়ের এসব ঘটনার সঙ্গে উর্ধ্বতন পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের সরাসরি যোগসূত্র প্রমাণিত হয়েছে।
রায় ঘোষণার তারিখ ও সম্প্রচার
গত ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার জন্য ১৩ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করে। নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী সোমবার দুপুরে ট্রাইব্যুনাল–১ এ রায় পড়া শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে রায়ের সব অংশ পড়ে শোনানোর পর দণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হয়।
এই রায় ঘোষণার কার্যক্রম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সরাসরি সম্প্রচার করে। বিটিভির মাধ্যমে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মও রায় ঘোষণার দৃশ্য রিলে করে, ফলে দেশে–বিদেশে বিপুলসংখ্যক দর্শক সরাসরি এই বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার সুযোগ পান।













