২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এই নারকীয় বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। এই ঘটনার পেছনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন উঠছে।
সম্প্রতি মানবজমিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সোহেল তাজ তার দিক থেকে ওই সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। তিনি জানান, ঘটনার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন এবং ঘটনার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে বসে যখন ঘটনার খবর পাই, তখনই আমি তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান যে পিলখানায় গোলাগুলি চলছে। আমি তাকে বলি, পুলিশ, র্যাব, আনসার, এপিবিএন সবাইকে নিয়ে পুরো পিলখানা ঘেরাও করতে হবে এবং প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে ডাকতে হবে। কিন্তু আইজিপি আমাকে জানান যে তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন এবং তাই আমার পরামর্শ তিনি মেনে চলতে পারছেন না।”
সোহেল তাজ আরও বলেন, “এরপর আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে ফোন করি এবং তাকে একই পরামর্শ দেই। কিন্তু তিনি জানান, ‘আপা (শেখ হাসিনা) দেখছেন।’ পরে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তাকে বলি, ‘যা ফোর্স আছে তা দিয়ে পুরো এলাকা ঘেরাও করতে হবে। আর্মি আসার আগ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ তবে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আমেরিকায় বসে বসে বেশি বুইঝো না। আমি দেখতেছি।’”
এছাড়া, সোহেল তাজ জানান, ওই সময়ে কিছু মহল তাকে বিদ্রোহের সঙ্গে জড়াতে চেষ্টা করেছিল, যা তিনি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, “বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট একিউজিশন। একজন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে এমনভাবে কালিমালিপ্ত করা উচিত নয়।”
সোহেল তাজের মতে, পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত এবং তিনি এই বিষয়ে পুনঃতদন্তের দাবিও জানান। “আমি সত্য জানতে চাই এবং ভবিষ্যতে পুনঃতদন্ত হলে আমার অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণগুলো জানাতে প্রস্তুত,” বলেন তিনি।
প্রায় ১৫ বছর পর, পিলখানা ট্র্যাজেডি পুনরায় আলোচনায় এসেছে, বিশেষ করে বিডিআর কল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে পুনঃতদন্তের দাবি ও ৯ দফা প্রস্তাবের মাধ্যমে। বিডিআর কল্যাণ পরিষদের উপদেষ্টা ফখরুল ইসলাম বলেন, “তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার একটি দেশকে সন্তুষ্ট করতে, সেনাবাহিনীর সামর্থ্য ক্ষুণ্ন এবং বাংলাদেশ রাইফেলসকে (বিডিআর) ধ্বংস করে নিজেদের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।”
পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের মধ্যে বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিম কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন, যা একটি হত্যা মামলার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ২৫শে আগস্ট ঢাকার মহানগর হাকিম মো. আখতারুজ্জামানের আদালতে আব্দুর রহিমের ছেলে এডভোকেট আব্দুল আজিজ এই মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বিজিবি মহাপরিচালক ও সাবেক সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ আহমেদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলায় অন্যান্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক কারা-মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সংসদ সদস্য শেখ সেলিম, নুর আলম চৌধুরী লিটন, শেখ হেলাল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম ও হাসানুল হক ইনু। ২০১০ সালের জুলাইয়ে দায়িত্বরত কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার এবং কারাগারের চিকিৎসকদেরও আসামি করা হয়েছে। মামলায় আরও অজ্ঞাতনামা ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিডিআর কল্যাণ পরিষদ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং চাকরিচ্যুত বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্যদের পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে। গত সপ্তাহে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিডিআর কল্যাণ পরিষদ এই দাবি তুলে ধরে এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য তদন্তের আহ্বান জানায়।
এই ঘটনাটি আজও বাংলাদেশে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
সুত্র/মানবজমিন/০৩/০৯/২০২৪