মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিসিআইসির সার ডিলারশীপকে ঘিরে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। খাতায়-কলমে ডিলারশীপ থাকলেও অনেকে বাস্তবে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন না। আবার একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নামে ডিলারশীপ থাকায় সিন্ডিকেটের প্রভাবে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সচেতন মহলের দাবি, সিন্ডিকেট ভাঙা না হলে কৃষকরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যদিও অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ডিলারদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ডিলারদের তালিকা
উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় বিসিআইসির অনুমোদনে ১০ জন ডিলার নিয়োগ পান। তাঁরা হলেন—
- পৌর এলাকায় মোমিনুল হোসেন সোহেল (সোহেল এন্টারপ্রাইজ)
- ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নে হাজী মস্তান মিয়া (জলি এন্টারপ্রাইজ)
- ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নে সুজিত দেব (ইকো এগ্রিকালচার স্টোর)
- ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নে অনুকুল চন্দ্র দাশ (জননী এন্টারপ্রাইজ)
- ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নে পলাশ দেব (মিতালী এন্টারপ্রাইজ)
- ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নে দিপলু আহমদ (সায়মা ট্রেডার্স)
- ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নে স্বপন কপালী (মনমোহন ট্রেডার্স)
- ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়নে ওয়াহিদুজ্জামান (জামান ট্রেডার্স)
- ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়নে শান্ত কপালী (উত্তরা ট্রেডার্স)
- ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নে পরিমল দাশ (রাহুল ট্রেডার্স)
পরবর্তীতে ডিলার সুজিব দেব মারা গেলে তাঁর স্ত্রী অর্পনা দেবের নামে এবং ওয়াহিদুজ্জামান মারা গেলে তাঁর স্ত্রী আবিদা সুলতানা চৌধুরীর নামে ডিলারশীপ হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় আরও ৬৪ জনকে খুচরা বিক্রেতা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিবারের প্রাধান্য
ডিলার নিয়োগের সময় নতুনদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও শরিক জাতীয় পার্টির কর্মী-সমর্থকরাই নিয়োগ পান। এর মধ্যে অনেকেই একই পরিবারের সদস্য। যেমন—
- হাজী মস্তান মিয়ার ছেলে বদরুল ইসলাম পৌর এলাকায় সাব-ডিলার।
- অনুকুল চন্দ্র দাশের ভাই পরিমল দাশ সাতগাঁও ইউনিয়নের ডিলার।
- অনুকুল চন্দ্র দাশের দুই শালা পান্না লাল দাশ ও বকুল দাশের নামে সাব-ডিলারশীপ রয়েছে, এমনকি পান্না লাল দাশ নিজেই জানেন না তাঁর নামে ডিলারশীপ আছে।
- স্বপন কপালী ও শান্ত কপালী চাচা-ভাতিজা সম্পর্কিত।
এমনকি বর্তমানে জেল হাজতে থাকা পৌর এলাকার ডিলার মোমিনুল হোসেন সোহেলের নামে অন্য ডিলাররা সার উত্তোলন করেছেন বলেও জানা যায়।
নীতিমালা ভঙ্গের অভিযোগ
সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা ২০০৯ অনুসারে প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৫০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার গুদাম ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে কোনো ইউনিয়নেই এ নিয়ম মানা হয়নি। প্রায় সব ডিলারের গুদাম ও দোকান পৌর এলাকায় অবস্থিত। এতে খুচরা বিক্রেতাদের অতিরিক্ত পরিবহন খরচ দিয়ে সার আনতে হয়, ফলে দাম বেড়ে যায়। মৌসুমে আবার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ডিলাররা অধিক মূল্যে সার বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিমত
খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকরা বলেন— “সার সহজলভ্য করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিলার নিয়োগ দেওয়া হলেও গত ১৬ বছর ধরে সিন্ডিকেট একাধিক লাইসেন্স ব্যবহার করে সংকট তৈরি করে চড়া দামে সার বিক্রি করছে।”
ডিলারদের বক্তব্য
- বদরুল ইসলাম দাবি করেন, খুচরা বিক্রেতাদের সব সময় প্রয়োজনমতো সার দেওয়া হচ্ছে।
- অর্পনা দেব স্বীকার করেন, তাঁদের ইউনিয়নে কোনো দোকান নেই, তবে শ্রীমঙ্গল নতুন বাজারে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
- অনুকুল চন্দ্র দাশ স্বীকার করেন, তিনি নিজের ভাই ও শালাদের ডিলারশীপ পরিচালনা করেন, তবে সংকট নেই।
- পলাশ দেব বলেন, সিন্দুরখানে গুদাম নেই, শহরে দোকান থেকে সার বিতরণ করেন।
- স্বপন কপালী জানান, তাঁর গুদাম আশীদ্রোন ইউনিয়নে আছে, নিয়মিত সার সরবরাহ করা হচ্ছে।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, “এখানে ১০টি ডিলার রয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সোহেল এন্টারপ্রাইজের মালিক জেলে থাকায় তাঁকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নিয়মিত ব্যবসা না করলে ডিলারশীপ বাতিল করা হবে।”
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ এলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”