মৌলভীবাজার ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
Logo জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান থেকে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পূর্ণ চিত্র Logo জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান মামলায় শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় Logo শ্রীমঙ্গলের দুই মডেলকে নিয়ে ভাইরাল ভিডিও পোস্ট; অপপ্রচার অভিযোগে থানায় জিডি করলেন জারা ইসলাম Logo রাজধানীর উত্তরা ১২ ও ১৪ নম্বর সেক্টরে রাজউকের অভিযান, ৫ ভবন ও ১৭ মিটার জব্দ Logo নিউইয়র্কের মেয়র হয়েই ট্রাম্পকে মামদানির হুঁশিয়ারি: ‘ভলিউম বাড়ান’ Logo শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সাংবাদিক এম. ইদ্রিস আলীর সদস্যপদ স্থগিত Logo সাংবাদিক ইদ্রিস আলীর বিয়ে বিতর্ক: ভাইরাল ভিডিও থেকে জাল এফিডেভিটের অভিযোগ! Logo মৌলভীবাজার জেলায় বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেলেন চার প্রার্থী Logo শ্রীমঙ্গলে সাংবাদিক এম ইদ্রিস আলীর ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ Logo শ্রীমঙ্গলে বিএনপি নেতার ভিডিও ভাইরাল: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়

জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান থেকে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পূর্ণ চিত্র

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত একজন ফাঁসির আসামি; তিনি এ মামলায় পলাতক, এবং দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছেন বলে সরকারি–আদালতীয় বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট মাসে ছাত্র–শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের গণ–অভ্যুত্থানকালে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও দমন–পীড়নের দায়েই তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলার বিচার ও ফাঁসির রায় হয়।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়: কে এই শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি প্রধান ও তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং এ সময়ে একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ডিজিটালাইজেশনের নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর কঠোরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কও ক্রমেই তীব্র হয়। এসব প্রেক্ষাপটে তাঁর শেষ দফা শাসনকাল culminate করে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে।


কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ–অভ্যুত্থান

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালের শুরু থেকে নানা কর্মসূচি চালিয়ে আসছিল। শুরুতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থাকলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন বিস্তৃত হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেফতার, হামলা ও গুলির ঘটনা ঘটতে থাকে।

এ সময় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিভিন্ন রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়, আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ, নির্যাতন, আটক, নিখোঁজ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বহু ছাত্র–যুবকসহ সাধারণ নাগরিক নিহত ও আহত হয়। এই দমন–পীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও পরিকল্পিত হামলার ধারাবাহিক ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়।


ক্ষমতাচ্যুতি ও ভারতে পলায়ন

গণ–অভ্যুত্থান তীব্র আকার ধারণ করলে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়লে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে লক্ষ্ণণীয়ভাবে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারান এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ ত্যাগ করেন—বিভিন্ন সূত্র, প্রতিবেদন ও রাজনৈতিক বিবৃতি অনুযায়ী তিনি পরে ভারতে অবস্থান নিতে সক্ষম হন।

পরবর্তীতে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সেটআপ গঠিত হলে তাঁকে “পলাতক আসামি” হিসেবে উল্লেখ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেই (trial in absentia) মামলার কার্যক্রম এগিয়ে চলে।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গঠিত অভিযোগ

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কয়েকটি মূল অভিযোগ গঠন করে। সংক্ষেপে এগুলো হলো:

  1. সারা দেশে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ
    ছাত্র–শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিক্ষোভ দমন করতে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দেন—এমন অভিযোগ আদালতে মামলার কেন্দ্রীয় ভিত্তি হিসেবে উত্থাপিত হয়।

  1. নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
    ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, চানখাঁরপুলসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যা এবং আশুলিয়া, সাভার, রংপুরসহ অন্য এলাকায় আগুন ও গুলিবর্ষণের মাধ্যমে মানুষ হত্যার ঘটনায় তাঁর নীতিগত নির্দেশ ও সম্মতির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করে।

  2. কমান্ড রেসপনসিবিলিটি ও হত্যার দায়
    আদালত বলে, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তাঁর ‘সুপিরিয়র কমান্ড’ ছিল। সারা দেশে এত বড় পরিসরে একই ধরনের হামলা, গুলিবর্ষণ ও দমন–পীড়ন চালানো হচ্ছে—এ তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি তা বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নেননি; বরং নির্দেশ ও অনুমোদনের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও নৃশংস দিকে ঠেলে দেন। এই অবস্থাকে “কমান্ড রেসপনসিবিলিটির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ততা” হিসেবে দেখা হয়।

  3. আহতদের চিকিৎসা বঞ্চিত করার অভিযোগ
    গুলিবিদ্ধ ও আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া, চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে অভিযান চালানোর ঘটনায়, শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ বা অনুমোদনের বিষয়টি আদালতে আলোচিত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অংশ হিসেবে গণ্য করে রায়ে উল্লেখ করা হয়।


প্রমাণ হিসেবে অডিও–ভিডিও, নথি ও সাক্ষ্য

প্রসিকিউশন আদালতে প্রচুর অডিও–ভিডিও ক্লিপ, টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড, সরকারি নথি, নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বার্তা, ড্রোন ও হেলিকপ্টারের ফ্লাইট লগসহ নানা ধরনের প্রমাণ উপস্থাপন করে। এসব অডিওতে দেখা যায়, আন্দোলন দমনে “কঠোর ব্যবস্থা”, “শক্তি প্রদর্শন”, “আকাশ থেকে গুলি” ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও নির্দেশের মতো বিষয় উঠে এসেছে বলে ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে।

এ ছাড়া শতাধিক ভুক্তভোগী, নিহতদের স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শী এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা–কর্মচারী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন—তারা কে কোথায়, কীভাবে গুলি হয়েছিল, কীভাবে লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়, কী পরিস্থিতিতে তাদের পরিবারের মানুষ নিখোঁজ বা নিহত হয়—এসব বিস্তারিত বর্ণনা করেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টেও একই সময়ের হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও গ্রেফতারের তথ্য থাকায় সেগুলোকে সহায়ক প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়।


ফাঁসির রায়: আদালত কী বলেছে

দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির দণ্ড দেয়। রায়ে সংক্ষেপে যেসব বিষয় স্পষ্ট করা হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • গণ–অভ্যুত্থান দমনে যে পরিকল্পিত ও ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয়েছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বা স্বতঃস্ফূর্ত আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়; বরং “রাষ্ট্র–সমর্থিত এবং শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদিত” হামলা হিসেবে আদালত অভিহিত করে।

  • একাধিক নির্দিষ্ট হত্যার ঘটনায় (যেমন নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট সংখ্যা মানুষকে গুলি/আগুনে হত্যা) তাঁর নির্দেশ, নীরব সমর্থন বা নীতি–নির্ধারণী ভূমিকার যথেষ্ট প্রমাণ আদালতে এসেছে—এ কারণে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ধরা হয়।

  • আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ—বিশেষ করে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও অমানবিক আচরণ—এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড; সেই বিধান অনুসারেই তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়।

এই রায়ের ফলে শেখ হাসিনা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান থেকে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পূর্ণ চিত্র

জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান থেকে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার পূর্ণ চিত্র

আপডেট সময় ০৫:১৪:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত একজন ফাঁসির আসামি; তিনি এ মামলায় পলাতক, এবং দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছেন বলে সরকারি–আদালতীয় বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট মাসে ছাত্র–শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের গণ–অভ্যুত্থানকালে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও দমন–পীড়নের দায়েই তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলার বিচার ও ফাঁসির রায় হয়।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়: কে এই শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি প্রধান ও তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এবং এ সময়ে একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ডিজিটালাইজেশনের নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর কঠোরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কও ক্রমেই তীব্র হয়। এসব প্রেক্ষাপটে তাঁর শেষ দফা শাসনকাল culminate করে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে।


কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ–অভ্যুত্থান

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালের শুরু থেকে নানা কর্মসূচি চালিয়ে আসছিল। শুরুতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থাকলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন বিস্তৃত হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেফতার, হামলা ও গুলির ঘটনা ঘটতে থাকে।

এ সময় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিভিন্ন রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়, আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ, নির্যাতন, আটক, নিখোঁজ ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বহু ছাত্র–যুবকসহ সাধারণ নাগরিক নিহত ও আহত হয়। এই দমন–পীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও পরিকল্পিত হামলার ধারাবাহিক ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়।


ক্ষমতাচ্যুতি ও ভারতে পলায়ন

গণ–অভ্যুত্থান তীব্র আকার ধারণ করলে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়লে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে লক্ষ্ণণীয়ভাবে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। সেই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারান এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ ত্যাগ করেন—বিভিন্ন সূত্র, প্রতিবেদন ও রাজনৈতিক বিবৃতি অনুযায়ী তিনি পরে ভারতে অবস্থান নিতে সক্ষম হন।

পরবর্তীতে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সেটআপ গঠিত হলে তাঁকে “পলাতক আসামি” হিসেবে উল্লেখ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেই (trial in absentia) মামলার কার্যক্রম এগিয়ে চলে।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গঠিত অভিযোগ

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কয়েকটি মূল অভিযোগ গঠন করে। সংক্ষেপে এগুলো হলো:

  1. সারা দেশে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ
    ছাত্র–শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিক্ষোভ দমন করতে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দেন—এমন অভিযোগ আদালতে মামলার কেন্দ্রীয় ভিত্তি হিসেবে উত্থাপিত হয়।

  1. নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
    ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, চানখাঁরপুলসহ বিভিন্ন স্থানে গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের হত্যা এবং আশুলিয়া, সাভার, রংপুরসহ অন্য এলাকায় আগুন ও গুলিবর্ষণের মাধ্যমে মানুষ হত্যার ঘটনায় তাঁর নীতিগত নির্দেশ ও সম্মতির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করে।

  2. কমান্ড রেসপনসিবিলিটি ও হত্যার দায়
    আদালত বলে, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধান হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তাঁর ‘সুপিরিয়র কমান্ড’ ছিল। সারা দেশে এত বড় পরিসরে একই ধরনের হামলা, গুলিবর্ষণ ও দমন–পীড়ন চালানো হচ্ছে—এ তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও তিনি তা বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নেননি; বরং নির্দেশ ও অনুমোদনের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও নৃশংস দিকে ঠেলে দেন। এই অবস্থাকে “কমান্ড রেসপনসিবিলিটির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ততা” হিসেবে দেখা হয়।

  3. আহতদের চিকিৎসা বঞ্চিত করার অভিযোগ
    গুলিবিদ্ধ ও আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া, চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে অভিযান চালানোর ঘটনায়, শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ বা অনুমোদনের বিষয়টি আদালতে আলোচিত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অংশ হিসেবে গণ্য করে রায়ে উল্লেখ করা হয়।


প্রমাণ হিসেবে অডিও–ভিডিও, নথি ও সাক্ষ্য

প্রসিকিউশন আদালতে প্রচুর অডিও–ভিডিও ক্লিপ, টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ড, সরকারি নথি, নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বার্তা, ড্রোন ও হেলিকপ্টারের ফ্লাইট লগসহ নানা ধরনের প্রমাণ উপস্থাপন করে। এসব অডিওতে দেখা যায়, আন্দোলন দমনে “কঠোর ব্যবস্থা”, “শক্তি প্রদর্শন”, “আকাশ থেকে গুলি” ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা ও নির্দেশের মতো বিষয় উঠে এসেছে বলে ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে।

এ ছাড়া শতাধিক ভুক্তভোগী, নিহতদের স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শী এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা–কর্মচারী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন—তারা কে কোথায়, কীভাবে গুলি হয়েছিল, কীভাবে লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়, কী পরিস্থিতিতে তাদের পরিবারের মানুষ নিখোঁজ বা নিহত হয়—এসব বিস্তারিত বর্ণনা করেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টেও একই সময়ের হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও গ্রেফতারের তথ্য থাকায় সেগুলোকে সহায়ক প্রমাণ হিসেবে দেখা হয়।


ফাঁসির রায়: আদালত কী বলেছে

দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির দণ্ড দেয়। রায়ে সংক্ষেপে যেসব বিষয় স্পষ্ট করা হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • গণ–অভ্যুত্থান দমনে যে পরিকল্পিত ও ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয়েছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বা স্বতঃস্ফূর্ত আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়; বরং “রাষ্ট্র–সমর্থিত এবং শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদিত” হামলা হিসেবে আদালত অভিহিত করে।

  • একাধিক নির্দিষ্ট হত্যার ঘটনায় (যেমন নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট সংখ্যা মানুষকে গুলি/আগুনে হত্যা) তাঁর নির্দেশ, নীরব সমর্থন বা নীতি–নির্ধারণী ভূমিকার যথেষ্ট প্রমাণ আদালতে এসেছে—এ কারণে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ধরা হয়।

  • আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ—বিশেষ করে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও অমানবিক আচরণ—এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড; সেই বিধান অনুসারেই তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়।

এই রায়ের ফলে শেখ হাসিনা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত।