আন্তর্জাতিক নারী দিবস, যা প্রতি বছর ৮ই মার্চ পালিত হয়, নারীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ন উপলক্ষ্য হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি নারীদের ন্যায্য অধিকার, সুযোগ, এবং পুরুষের সঙ্গে সমতা অর্জনের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। তবে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী এবং পুরুষের মধ্যে সমতা, শ্রদ্ধা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনেক আগেই চিরস্থায়ী ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইসলামে নারীর প্রতি যে বিশেষ সম্মান এবং মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তা আধুনিক সমাজের অনেকের কাছে অজানা বা ভুল ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। অথচ ইসলামে নারীদের অধিকার, সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এক অনন্য রূপে, যা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আধুনিক বিশ্বের অনেক অগ্রগামী চিন্তা ও আইনসমূহের চেয়ে এগিয়ে ছিল।
এই নিবন্ধে আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর অধিকার, ইসলামে নারীর স্বাধীনতা, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক অধিকার, এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নারীদের প্রতি যে অমোঘ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। এই আলোচনা মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারবো কেন ইসলাম নারীদেরকে সম্মান দিয়েছে এবং ইসলামের শিখানো দৃষ্টিতে নারীদের ক্ষমতায়ন কীভাবে সম্ভব।
১. ইসলামে নারীর অধিকার এবং মর্যাদা
ইসলাম আসার পূর্বে, বিশেষ করে আরব সমাজে নারীরা ছিল অত্যন্ত অবহেলিত, নিপীড়িত এবং অত্যাচারের শিকার। গর্ভবতী মায়েরা অবলীলায় খুন হয়ে যেতেন, মৃত সন্তানের কবর দেয়ার জন্য জীবন্ত মেয়ে শিশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হত। নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল একেবারেই শূন্য। এই অবস্থা থেকে মুক্তি এনে ইসলাম নারীর প্রতি যে সম্মান, অধিকার এবং মর্যাদা প্রদান করেছে, তা ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন।
১.১. ইসলামে নারী-পুরুষের সমতা
ইসলামের মূলনীতির মধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা। ইসলাম নারীকে শুধু শারীরিকভাবে নয়, বরং আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছে। ইসলামে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই, এবং দুটি সত্ত্বার একই অধিকার, সুযোগ, এবং মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি সেই, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু।” (সূরা হুজরাত, ৪৯:১৩)
এই আয়াতটির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর মর্যাদা পুরুষের থেকে আলাদা নয়। বরং, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ভালো কাজ করে, সে সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জন করবে—যে নারী বা পুরুষই হোক।
১.২. নারীকে শিক্ষা লাভের অধিকার
ইসলামে নারীকে শিক্ষা লাভের অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক কোরানিক আদেশই ছিল—“অভ্যাস শুরু করো, যা তোমাকে আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা দিবে।” প্রথম আয়াতটি যা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটি ছিল “ইকরা” বা “পড়ো”। এটি পুরুষ ও নারীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
ইসলামে নারীকে কোনো ক্ষেত্রেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার ধারণা নেই। বরং, আল্লাহপাক নারীদের বিদ্যা অর্জন এবং জ্ঞান লাভের সুযোগ দিয়েছেন। কুরআনে বারংবার জ্ঞান অর্জন এবং শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যেমন:
“পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল আলাক, ৯৬:১)
এই আয়াতটির মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়কেই শিক্ষা অর্জনের অধিকার দেয়া হয়েছে।
১.৩. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
ইসলামে নারীকে সম্পত্তির অধিকার প্রদান করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সমাজে নারী ছিল সম্পত্তির অংশ এবং তার কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। ইসলাম এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে নারীদের সম্পত্তি, হেরিটেজ, এবং আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। নারীদের নিজস্ব সম্পত্তি থাকতে পারে, তারা নিজে উপার্জন করতে পারে এবং তা তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে।
সূরা নিসা (৪:৭) এর মাধ্যমে আল্লাহ বলেন:
“পুরুষের জন্য রয়েছে যা কিছু তার পিতামহ বা পুরুষেরা রেখে যান, তেমনি নারীর জন্যও রয়েছে যা কিছু তার পিতামহ বা নারীরা রেখে যান।” (সূরা নিসা, ৪:৭)
এটি স্পষ্ট নির্দেশ দেয় যে, নারীরও সম্পত্তির অধিকার রয়েছে এবং তারা তার স্বকীয় মালিকানা কেবলমাত্র নিজেদের অধীনে রাখতে সক্ষম।
১.৪. বিবাহ ও সংসার
ইসলামে নারীর সম্মতি ছাড়া বিবাহের কোনো সুযোগ নেই। ইসলামের প্রথম যুগে, যখন নারীদের নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হত, তখন ইসলামে নারীদের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এ কথা স্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে:
“তোমরা তাদের (নারীকে) বিয়ে করো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়।” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৯)
এতে নারীকে সম্মতির অধিকার দেয়া হয়েছে, এবং তাদের মতামত ছাড়া বিয়ে সম্ভব নয়।
২. হযরত মুহাম্মদ (সা.) নারীদের সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেছেন
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের মধ্যে নারীদের প্রতি অমূল্য সম্মান প্রদান করেছেন। তাঁর জীবন ও আচার-আচরণ নারীদের প্রতি ইসলামের সৃষ্ট নৈতিকতার একটি প্রকৃত উদাহরণ হয়ে উঠেছে। তাঁর শিক্ষা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে নারীদের প্রতি সকল ধরনের অবহেলা, নিপীড়ন, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়েছে।
২.১. নারীদের সম্মান
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন:
“তোমরা নারীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো, কারণ তারা তোমাদের নরম সঙ্গী এবং তারা তোমাদের খোদা এবং পুরুষদের মতোই অধিকারী।” (সহীহ মুসলিম)
এবং আরও বলেছেন:
“একজন মুসলমান পুরুষের জন্য তার স্ত্রীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া জরুরি, যারা তাদের স্ত্রীর সম্মান করে না, সে প্রকৃত মুসলিম নয়।” (তিরমিজি)
এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয় যে, একজন মুসলিম পুরুষের জন্য তার স্ত্রীর সম্মান করা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২.২. নারীদের প্রতি দয়ালু আচরণ
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন:
“তোমরা নারীদের প্রতি দয়ালু হও, কারণ তারা তোমাদের মধ্যে এক দুর্বল শ্রেণী।” (সহীহ বুখারি)
এটি নারীদের প্রতি পুরুষদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
২.৩. নারীদের সম্মান ও সহানুভূতির শিক্ষা
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবনে তাঁর স্ত্রীর প্রতি প্রচুর শ্রদ্ধা, সম্মান, এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন। তার জীবন প্রমাণ করে যে, তিনি একজন উত্তম স্বামী এবং একজন মহৎ ব্যক্তিত্ব যিনি নারীকে শুদ্ধভাবে সম্মান করেছেন।
২.৪. নারীদের কাজের মধ্যে অংশগ্রহণ
হযরত মুহাম্মদ (সা.) নারীদেরকে কেবল গৃহিণী হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তাদেরকে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য উৎসাহিত করেছেন। যেমন, হযরত আয়েশা (রা.)-এর মতো নারী মুমিনেরা ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) শুধুমাত্র এক নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, বরং যুদ্ধক্ষেত্রেও তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।
৩. নারীর ক্ষমতায়ন: ইসলামে নারীর সামাজিক ভূমিকা
ইসলামে নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব একটি মৌলিক বিষয়। যেহেতু ইসলাম নারীর সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং পারিবারিক ভূমিকা নিশ্চিত করেছে, তাই ইসলামে নারীর ভূমিকা কেবল গৃহস্থালী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
৩.১. নারীদের অংশগ্রহণে সুরক্ষা
ইসলামে নারীকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং সমর্থন প্রদান করা হয়েছে। তাকে নির্যাতন, সহিংসতা, বা অবহেলা সহ্য করতে হবে না।
৩.২. নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা
ইসলামি রাষ্ট্রে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও তার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন:
“তোমরা নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার করো।”
এটি এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে নারীরা সমান অধিকার, মর্যাদা, স্বাধীনতা, এবং নিরাপত্তা পায়।
উপসংহার
ইসলাম নারীদের প্রতি যে সমস্ত অধিকার এবং মর্যাদা দিয়েছে, তা আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, এবং বৈবাহিক স্বাধীনতা — এসব দিকেই ইসলাম নারীকে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার দিয়েছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের উচিত ইসলামের এই মহামূল্যবান শিক্ষা তুলে ধরা এবং নারী-পুরুষের মধ্যে প্রকৃত সমতার আদর্শ বাস্তবায়ন করা।